বাণিজ্যের বাইরে কূটনৈতিক চাপ, ওয়াশিংটনে যাচ্ছে বাংলাদেশি প্রতিনিধি দল

0

যুক্তরাষ্ট্রে বাড়তি শুল্ক এড়াতে শেষ মুহূর্তে আলোচনায় যাচ্ছে বাংলাদেশ: চীনের প্রভাব রুখতেই কি কৌশলগত চাপ?

স্টাফ রিপোর্ট | ঢাকা, ১৬ জুলাই ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত দেশের রপ্তানি খাতে শঙ্কার ছায়া ফেলেছে। এমন অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে তৃতীয় দফায় আলোচনার জন্য ওয়াশিংটন যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল। আলোচনায় শুধু বাণিজ্য নয়, জড়িয়ে আছে ভূরাজনীতি, কৌশলগত চাপ আর বড় শক্তিগুলোর প্রভাব বলয়েও নিজেকে টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আলোচনার নেতৃত্ব দেবেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তাঁর দলে থাকছেন পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। প্রতিনিধি দল আগামী সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

৩৫ শতাংশ বাড়তি শুল্কের হুমকি

গত ৭ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র ১৪টি দেশের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়। এতে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। শুরুতে শুল্ক কার্যকর হওয়ার তারিখ ছিল ৯ জুলাই, তবে তা পিছিয়ে ১ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যেই আলোচনা করে যুক্তরাষ্ট্রকে ন্যায্য অবস্থানে আনতে চায় বাংলাদেশ।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮৬৯ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যার ৮৫ শতাংশই তৈরি পোশাক। ফলে এ শুল্ক কার্যকর হলে সবচেয়ে বড় আঘাতটাই আসবে পোশাক শিল্পে। তারওপর মাথার টুপি, জুতা, হোম টেক্সটাইল—সবকিছুই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিপুল রপ্তানির আওতায়।

আলোচনায় চীন–যুক্তরাষ্ট্র প্রতিযোগিতা?

তবে আলোচনার বিষয় শুধু শুল্কেই সীমাবদ্ধ নয়। একাধিক ব্যবসায়ী নেতা ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আলোচনা ঘিরে কিছু স্পর্শকাতর কৌশলগত শর্তও তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে অন্যতম—বাংলাদেশ যেন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা না করে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরান বা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, বাংলাদেশকেও তাতে সঙ্গী হতে হবে।

এ ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বাংলাদেশ সামরিক সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে চীনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে মার্কিন সামরিক পণ্যের দিকে ঝুঁকুক। পাশাপাশি এমন শর্তও আছে, যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে, সেই সুবিধা যেন অন্য কোনো দেশ—বিশেষ করে চীন—না পায়।

“এটা শুধু বাণিজ্য নয়, কৌশলগত জটিলতা”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী নেতা বলেন,

“যুক্তরাষ্ট্র আমাদের চীনের বলয়ের বাইরে রাখতে চায়। তারা চাইছে আমরা যেন ব্যবসা ও বিনিয়োগে চীনের প্রতি আগ্রহ না দেখাই। এটা আর স্রেফ শুল্ক আলোচনার বিষয় নেই, বড় কৌশলগত প্রতিযোগিতা এর পেছনে কাজ করছে।”

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশ চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে’ যুক্ত, আবার মার্কিন জিএসপি সুবিধার অপেক্ষাতেও আছে। ফলে দুই প্রান্তে ভারসাম্য রাখাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও আশাবাদ

গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় দফার আলোচনা শেষে দেশে ফিরে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন,

“আলোচনা ছিল হৃদ্যতাপূর্ণ ও উৎসাহব্যঞ্জক। আমাদের দল তৃতীয় দফার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আশা করি, যুক্তরাষ্ট্র যৌক্তিক একটা শুল্ক হার নির্ধারণ করবে, যাতে বাংলাদেশ এই বাজারে প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে পারে।”

বাণিজ্য সচিব মো. মাহবুবুর রহমান জানান, ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে তাঁদের মতামত নেওয়া হয়েছে। আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক থেকেও পরামর্শ নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনায় যাবে বাংলাদেশ।

রাজনৈতিক ঐক্যও জরুরি—ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক

বাণিজ্যিক চাপ সামাল দিতে এবার রাজনৈতিক পর্যায়ে ঐক্য দরকার—এমন বার্তা নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী রাজধানীর বনানীতে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

বৈঠকে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, এফবিসিসিআই, এমসিসিআইসহ শীর্ষ সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় তারা রাজনৈতিক ঐক্য ও দায়িত্বশীলতা চেয়েছেন।

বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন,

“আমরা বলেছি—যুক্তরাষ্ট্রে পাল্টা শুল্ক যেন আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে ধ্বংস না করে। ভারত বা ভিয়েতনামের মতো হার হলে আমরা টিকে থাকব। সব পক্ষকেই দায়িত্ব নিতে হবে।”

আমীর খসরু বলেন,

“এই শুল্ক আলোচনা কেবল বাণিজ্যিক নয়, জাতীয় স্বার্থের ব্যাপার। বিএনপি সরকারকে আলোচনার প্রস্তাব দেবে যাতে ব্যবসায়ীদের মতামত গুরুত্ব পায়। দেশের স্বার্থেই ঐক্য দরকার।”


এবারের যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ আলোচনা আর কোনো একক শিল্পখাত বা অর্থনৈতিক সুবিধার বিষয়ে নয়। বরং এটি জড়িয়ে আছে ভূরাজনীতির মোড় ঘোরানো খেলায়। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রভাব বলয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ যে ভারসাম্য রক্ষা করতে চাইছে, সেই পথচলাটাই হয়তো আগামী দিনের কূটনৈতিক বাস্তবতা নির্ধারণ করে দেবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.